একটা সময় ছিল, বাচ্চারা নিজেরাই ইস্কুলে যেত, নিজেরাই ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরতো। অভিভাবকের সাহায্যের দরকার পড়তো না। আমি ছিলাম মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। আমাকে বাড়ির কেউ ইস্কুলে নিয়ে যায়নি, ইস্কুল থেকে ফেরতও আনেনি। ইস্কুলে পায়ে হেঁটে অথবা রিক্সায় চড়ে যেতাম। সংগে পাড়ার ইস্কুলযাত্রী ছেলেমেয়ে থাকতো। এখন তো দেখি ইস্কুলের ছেলেমেয়েদের ইস্কুলে দিয়ে আসে অভিভাবকেরা, নিয়েও আসে। এত সাবধানতা, তারপরও শুনি শিশুধর্ষণ বাড়ছে। শিশুধর্ষণের খবর শুনতে শুনতে এখন কোনও শিশুকে স্বজন দ্বারা বেষ্টিত না দেখলে আশংকা হয়। আগে আমরা ছ’সাত বছর বয়সে মামা কাকাদের সংগে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়তাম। এখন মামা কাকারা ছ’সাত বছরের শিশুকে নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরোলে আশংকা হয়। মামা কাকারা শিশুকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করে পালিয়ে গেছে, এমন খবর আজকাল শুনতে হয়। বয়স্ক পড়শিরাও একই কীর্তি করছে। কাকে বিশ্বাস করবে মানুষ? শিশুরা কি বাবার কোলে নিরাপদ? না, বাবাও আপন কন্যাকে ধর্ষণ করে। কোনও বাবাকে যখন দেখি তার কন্যাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে, সন্দেহ হয়। সত্যি হয়। খবরের কাগজে কি পড়ি না কোনও কোনও বাবা কন্যাকে ধর্ষণ করে? বছরের পর বছর ধর্ষণ করছে? পৃথিবীটা বড় কুৎসিত হয়ে গেছে। বাবার কাছেই যদি কন্যা নিরাপদ নয়, তবে কন্যা কোথায় নিরাপদ? সত্যি কথা বলতে কী, কন্যা কোথাও নিরাপদ নয়। ঘরে বাইরে সর্বত্র কন্যা বিপদের মুখে। যে কোনও সময় যে কেউ, যে কোনও কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ তাকে ধর্ষণ করতে পারে, তাকে গণধর্ষণ করতে পারে, তাকে অবশেষে খুন করতে পারে। এসব দুর্ভাবনা অমূলক নয়, অমূলক নয়, কারণ এইসব ঘটছে ।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, গত বছর সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা প্রচুর ঘটেছে, মত প্রকাশে বাধা দেওয়া হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা এবং হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। গণপিটুনিতে গতবছর নিহত হয়েছে ৬৫ জন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ৩৮৮ জন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা বিরতিহীন ভাবে চলেছে। মোট ২০৯টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব রাজনৈতিক সংঘাতে ৩৯ জন নিহত এবং আহত হন ২৬৮৯ জন। এবং, গত বছরের তুলনায় শিশুধর্ষণ ও বলাৎকারের ঘটনা বেড়েছে।
দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র না থাকলে মত প্রকাশের অধিকার থাকে না। তখন বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর আক্রমণ বাড়ে, সাংবাদিক এবং মুক্তচিন্তকদের ওপর অত্যাচার বাড়ে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাড়ে। কিন্তু পুরুষতন্ত্র পুরু হলে নৈতিকতার অবক্ষয় বাড়ে, নৈতিকতার অবক্ষয় বাড়লে নারী নির্যাতন বাড়ে।
ধর্ষকরা আজকাল প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের চেয়েও বেশি পছন্দ করছে শিশু। অবশ্য ৬ মাস বয়সী শিশু থেকে ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত মহিলাদের তারা ধর্ষণ করছে, কাউকে রেহাই দিচ্ছে না। সকল ধর্ষণই ভয়াবহ। তবে শিশুধর্ষণ সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ। শিশু দুর্বল, শিশু জানে না ধর্ষণ কাকে বলে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সে পারে না। ধর্ষণের কারণে শিশুর মৃত্যু হওয়ার আশংকা প্রাপ্তবয়স্কাদের চেয়ে বেশি। পৃথিবীতে একটা নিয়ম ছিল, কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে শিশু এবং নারীকে সবার আগে বাঁচানোর নিয়ম। সেই নিয়মটি এখন সম্পূর্ণই বদলে গেছে। শিশু এবং নারীকে এখন সবার আগে মারা হয়। বধূ হত্যায় পুরুষের আপত্তি নেই, এক বধূ গেলে আরেক বধূ মিলবে। অনাঘ্রাতা কুমারী মেয়ের স্বাদ পাওয়ার জন্য যুবক বৃদ্ধ সকলের জিভ বেরিয়ে আসে। এই বেরিয়ে আসা জিভকে কখনও তিরস্কার করা হয়না। বরং সমর্থন দেওয়া হয়েছে এই বলে যে পুরুষকে কাম ক্রোধ একটু বেশিই দিয়েছে ঈশ্বর। ঈশ্বরের দানের বিরুদ্ধে কারও প্রতিবাদ করার অধিকার নেই। বৃদ্ধদের হাতে চিরকাল সম্প্রদান করা হয়েছে কচি মেয়ে। কচি থেকে কচিতর, কচিতর থেকে কচিতম— হাত বাড়াতে বাড়াতে দুধের বাচ্চার যোনাঙ্গে হাত দিয়েছে পুরুষেরা। আমি আজও বুঝি না, কী করে দুধের বাচ্চাকে বলাৎকার করার জন্য শরীরে এবং মনে তৈরি হয় ওরা? কী করে ওদের যৌন উত্তেজনা জাগে? পুরুষের শুক্রাণু মানবজন্মে সাহায্য করে বটে, এর মানে কিন্তু এই নয় যে শুক্রাণু নির্গত করলেই পিতা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যায়।
কিছু পুরুষ হয়তো জন্মগত ভাবে শিশুকামী। শিশুকামী মস্তিস্ক নিয়েই জন্ম হয়েছে তাদের। তারাও কিন্তু পারে হাত গুটিয়ে নিতে, পারে নিজেকে শাসন করতে। কোনও শিশুর অনিষ্ট না করতে চাইলে তাদের পক্ষেও সম্ভব কোনও শিশুর অনিষ্ট না করা। তোমার যৌন উত্তেজনা জাগছে , তাই বলে তুমি কিন্তু কারও ওপর ঝাপিয়ে পড়ার অধিকার রাখো না যতক্ষণ না সে তোমার ঝাপিয়ে পড়াকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে । একটি শিশু কখনও আমন্ত্রণ জানায় না। কারণ শিশুর যৌনবোধ নেই। যৌনবোধ যদি কিছু শিশুর থাকেও, তাহলেও শিশুকে প্রতারণা করার অধিকার কোনও প্রাপ্তবয়স্কের নেই। নিজেকে মন্দ কাজ থেকে আমরা সব সময় সংবরণ করছি। আমাদের হাত কি নিশপিশ করে না একে ওকে পেটাতে, চাবকাতে, গায়ের চামড়া তুলে ফেলতে ? ইচ্ছে করে। কিন্তু আমরা নিজের অবাধ ইচ্ছের লাগাম টেনে ধরতে জানি। অন্যের অনিষ্ট করবো না, এমন কী দোষীরও অনিষ্ট করবো না, দেশের বিচার ব্যবস্থার কাছে আমরা বিচারের ভার ছেড়ে দিই। কেউ কেউ ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দেয় বিচারের দায়িত্ব। শুধু শিশুকামী নয়, সমকামী, উভকামী, বিষমকামী বা অসমকামী, কারও অধিকার নেই কাউকে যৌন হেনস্থা , যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ করার।
আমাদের সমাজের বড় সমস্যা এই, নীতিবান এবং আদর্শবান হওয়ার, নারীর সমানাধিকার মানার উপদেশ যত না দেওয়া হয় ছেলেশিশুদের, তার চেয়ে বেশি দেওয়া হয় ক্লাসে প্রথম হওয়ার উপদেশ, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার উপদেশ, যে করেই হোক ধনী হওয়ার উপদেশ। ছেলেশিশুদের আস্কারা দিয়ে অপদার্থ বানায় অভিভাবকেরা। ছেলেদের অপদার্থ বানাবার সংস্কৃতিটা যতদিন বিদেয় না হচ্ছে সমাজ থেকে, ততদিন নারী নির্যাতন, মেয়েশিশু নির্যাতন কমবে না, বরং বছর বছর বাড়বে।
মেয়েশিশুরা মাঠে খেলবে, রাস্তায় হাঁটবে, একা ইস্কুলে যাবে, মাঠ ঘাট হাট সব নিরাপদ তাদের জন্য। কিশোরীরা তাদের যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াবে, সর্বত্র তারা নিরাপদ বোধ করবে। তরুণী, যুবতী, প্রবীনা, বৃদ্ধা সবার জন্য প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি শহর নিরাপদ। কবে আসবে সে দিন। কবে আসবে সে দিন যে দিন কোনও মেয়ের বলার দরকার হবে না, হিজাব বা বোরখা পরলে যৌন নির্যাতন থেকে বাঁচা যায়। যৌন নির্যাতন থেকে তাদের বাঁচাবে হিজাব বা বোরখা নয়, বাঁচাবে পুরুষের নৈতিকতা আর সততা ।
অনেকে নিজেদের অপকর্ম এবং দুষ্কর্মের পক্ষে বলতে গিয়ে জোর গলায় বলে, পাশ্চাত্যে অনেক বেশি শিশুধর্ষণ ঘটে। যেন পাশ্চাত্যে যেহেতু অনেক বেশি শিশুধর্ষণ ঘটে, প্রাচ্যেও শিশুধর্ষণ ঘটলে কোনও ক্ষতি নেই। পাশ্চাত্যে অনেক বেশি শিশুধর্ষণ ঘটে না, পাশ্চাত্যে একটি ঘটনা ঘটলে তোলপাড় শুরু হয়, দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। প্রাচ্যে শিশুধর্ষণ, শিশুহত্যা, নারীধর্ষণ, নারীহত্যা চুপচাপ ঘটতে থাকে। পাঁচশ’ ঘটনার একটি ঘটনা সামনে আসে কিনা সন্দেহ। ভুলে গেলে চলবে না , পাশ্চাত্যে শুধু সাদা ককেশিয়ানদের বাস নয়, হলুদ বাদামি কালো অর্থাৎ এশিয়া, আফ্রিকার লোকদেরও বাস বটে, তাদের নারীবিরোধী পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি পাশ্চাত্যেও তারা ঘটা করে পালন করে।
শিশুধর্ষণ বাংলাদেশে বাড়ছে, নারীনির্যাতন বাড়ছে, এই তথ্যটি ধামাচাপা দিয়ে বাংলাদেশের লোকেরা, এমনকী প্রধানমন্ত্রীও গর্ব করে বলেন দেশের অর্থনীতির উন্নতি হচ্ছে। উন্নতি হচ্ছে সুতরাং বগল বাজাও, আনন্দ করো। তাই কি হওয়া উচিত? অর্থনৈতিক উন্নতি দিয়ে ছাই হবে যদি জনগণের নৈতিক উন্নতি না হয়। যতক্ষণ নারী এবং শিশুর জন্য দেশের প্রতিটি ইঞ্চি মাটি নিরাপদ না হয়, ততক্ষণ এই মাটি নারী বা শিশুর দেশ নয়। যে মাটিতে জন্মেছে মানুষ, সে মাটি যদি দেশ হওয়ার যোগ্যতা হারায়, তবে এ কার দোষ? তার এবং তাদের দোষ যারা রাষ্ট্র , সমাজ এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমন ভাবে গড়েছে যে ব্যবস্থাগুলো পুরুষকে ধর্ষক বানায়, আর নারীকে পুরুষের শিকার বানায়। এই ব্যবস্থাগুলোয় অর্থনৈতিক উন্নতি ঢাললে তা চিকচিক করে বটে, কিন্তু কান পাতলেই শোনা যায় নিপীড়িত নারীর আর্তনাদ।
যে বছর শুরু হলো, সে বছরের শেষে আশা করছি খবর হবে এ বছর কোনও শিশুকে ধর্ষণ করা হয়নি, কোনও নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়নি।
শ্রীমতী তসলিমা নাসরিন!! আমি তোমার *মেধার আলোর দর্শন পেলাম….. আজ….. তোমার প্রথম বাংলা ব্লগ লেখা পড়ে আমি অভিভূত…..!
তোমার দুপায়ে….. আমার মাথা রেখে প্রনাম করছি ….. স্বীকার কোর।
তোমাকে প্রনাম করে _ _ _ নিয়ে _ _ _ইচ্ছে হচ্ছে তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি।
আমার হৃদয়…..
তোমার জন্য একটা সেল
( কোষ ) তৈরি হয়েছে বলে জানান দিচ্ছে।
তুমি এ *পৃথিবীর জন্য *আশা।
তোমাকে প্রনাম।
পুনঃ : আমি ….. ইন্টারনেট মেসেনজারে তোমায় ইংরেজি মেসেজ পাঠিয়েছি….. ওটা দেখো।
ইতি ভবদীয়া
(প্রসেনজিৎ)
+প্রসেনজিৎ রায়
নিজগুণে ভুল মার্জনা কোর
You are right brother.she is a hero//
শ্রদ্ধেয়া নাসরিন দিদি,
আমি আপনার একনিষ্ঠ ভক্ত সেই ১০ বছর বয়স থেকেই। আমার জন্মদিনে প্রতি বছর বই নিতাম উপহার হিসেবে। সেই ১০-১১ বছরেই পড়েছিলাম ” আমার মেয়েবেলা”। আপনি আমার অনুপ্রেরণা। এরপর আপনার ফরাসি প্রেমিক, নির্বাচিত কলম, দ্বিখণ্ডিত, লজ্জা আরো অনেক। পুরুষ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, ধর্ম এইসব বিষয়ে আমি একমত আপনার সাথে। দিদি, আমি পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে, কলকাতার কাছে থাকি, আমি সমাজকে দেখেছি অন্যভাবে। আপনার মতো মানুষ, আপনার লড়াই দেখে আমি মুগ্ধ। প্রণাম নেবেন দিদি।
Thanks for this useful content.
Only quality people can
make quality living place