বিদেশে থাকবো না, দেশে আবেগ, দেশে ভালোবাসা, দেশে আন্তরিকতা, দেশে চোখের জল, দেশে সত্যিকার বন্ধুত্ব, দেশে দয়ামায়া — এসব বলে বলে বিদেশ ছাড়লাম। দেশে আমাকে পা রাখতে দিল না দুই নবাবিনী। দেশ যেন তারা বিইয়ে নিয়েছে অথবা গাঁটের পয়সায় কিনে নিয়েছে এমন ভাব। অগত্যা পাশের দেশ, দেশের মতো দেখতে দেশ, ভারতে বাস করতে শুরু করেছি। আমরা তো এক কালের ভারতই। ভাষা কালচার সব তো একই। কাঁটাতার বসিয়ে দিলেই কি মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করা যায়?
আমার আশেপাশের সাধারণ মানুষদের কেমন দেখছি এখানে? পারতপক্ষে সত্যি কথা কেউ বলে না। যেদিকেই তাকাই, কী করে কাকে ঠকাতে হবে, কী করে চুরি করতে হবে, সুযোগ পেলে ডাকাতি করতে হবে, কাকে ল্যাং মারতে হবে, কাকে ফাঁসাতে হবে — এই নিয়ে লোকের ভাবনা চিন্তা। ওপরে আবেগ দেখাচ্ছে , ভেতরে ছিটেফোঁটা নেই। আন্তরিকতার তুবড়ি ছোটাচ্ছে, অন্তরে বিষ। সকলেই ব্যস্ত নিজের আখের, আরাম আয়েশ, পয়সা কড়ি গোছাতে। চরম অসৎ আর নিষ্ঠুর হতে পারে এরাই। আমার চেনা ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ৮০ জনের অবস্থা এরকমই। বাংলাদেশের হালও নিশ্চয়ই একই।
পুব এবং পশ্চিম সম্পর্কে, মানুষের, আমার মনে হয়, বরাবরই ভুল ধারণা। আসলে সততা, সরলতা, আবেগ, আন্তরিকতা, মানুষের জন্য মানুষের দয়ামায়া, স্নেহ মমতা এসব যদি কোথাও থাকে, তবে পাশ্চাত্যেই। ওখানকার শাসকদের কথা বলছি না। নাৎসিদের কথাও বলছি না। ওখানকার সাধারণ মানুষের কথা বলছি। ওরা এখনও নিঃস্বার্থ হতে পারে, এখনও মানুষের জন্য ভালোবাসাটা ওদের নিখুঁত, এখনও মানুষ মানুষের জন্য কাঁদে। ওদের মধ্যেও স্বার্থপর আছে, নিষ্ঠুর আছে, বর্ণবাদী আছে, প্রচুর আছে। কিন্তু দরিদ্রর জন্য, পশুপাখির জন্য, গাছপালার জন্য, ভালোবাসার মানুষের জন্য, আত্মীয় স্বজনের জন্য, বন্ধুদের জন্য ওরা যা করে, আমাদের অঞ্চলের লোকেরা তার কিছুই করে না।
সম্ভবত যত সভ্য হচ্ছে, তত পৃথিবীর ভালোর জন্য ভাবছে ওরা। সুইডেনের ১৪ বছরের মেয়ে গ্রেটা থানবার্গ ক্লাইমেট বাঁচাবার জন্য একা একাই ধনী দেশগুলোর বিরুদ্ধে লড়ছে। কঙ্গোর জঙ্গলে গরিলাদের বাঁচাবার জন্য ইউরোপ আমেরিকা থেকেই লোক যায়। কোথাও বন্যা হচ্ছে, কোথাও মানুষ না খেয়ে থাকছে, ব্যস রুখসাক কাঁধে চলে যাচ্ছে এশিয়া আফ্রিকায় । যুদ্ধ বন্ধ করার মিছিল সবচেয়ে বেশি ওখানেই বের হয়। সিরিয়া থেকে আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে বরণ করে নিয়েছিল সাধারণ জার্মানরাই। সভ্য হয়েছে বলেই ওরা সৎ , সচেতন, সংবেদনশীল, সহিষ্ণু। শরণার্থীদের মধ্য থেকে কালপ্রিট বেরোচ্ছে, তারপরও শরণার্থীদের সেবাযত্ন করে যাচ্ছে পাশ্চাত্যের সভ্য ছেলেমেয়েই। একবার আফগানিস্তানের একটি লোককে সুইডেনের সরকার ডিপোর্ট করার পর, উড়োজাহাজ থেকে সেই লোকের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেঁদে কেটে তাকে সুইডেনের মাটিতে নামিয়েছিল এক সুইডিশ তরুণী। কে কার মানবাধিকারের জন্য এভাবে লড়ে? এসব প্রাচ্যে হয় না, হয় পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় । অতীতে পাশ্চাত্যের ভূমিকা মন্দ ছিল, প্রাচ্যে এসে বিস্তর শোষণ করেছে। অতীতে ওরা সভ্য ছিল না। এখন, বিশেষ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সভ্য হয়েছে বলেই দুনিয়ার তাবৎ মানুষের মঙ্গলের জন্য অসাধারণ মানবাধিকার সনদ লিখতে পেরেছে।
এখনও আমাদের অঞ্চল সভ্য নয় বলেই মানুষ স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, দয়ামায়াহীন, বর্বর, কুটিল, কদাকার। সভ্যতা মানুষকে সুন্দর করে, মহান করে, বিরাট করে, বিশাল করে।
Leave a Reply